⚖️ আগাম জামিন বা Anticipatory bail কি?
- Author: MD Sirajul Islam, Inspector of Police
- Published: 1 month ago
- Category: ফৌজদারী কার্যবিধি
-
কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পূর্বেই জামিন প্রদান করাকে আগাম জামিন বলা হয়। ১৯৭৮ সালের আইন সংস্কার অধ্যাদেশে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের আশংকা থাকলে তাকে জামিন প্রদানের জন্য ফৌজদারী কার্যবিধিতে ৪৯৭-ক ধারাটি সংযোজন করা হয়েছিল। কিন্তু এ ধারার প্রয়োগ সঠিকভাবে না হওয়াতে ১৯৮২ সালের নবম অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ ধারাটি বাদ দেয়া হয়েছে। তারপরও আগাম জামিনের প্রয়োজনীয়তা থেকে যায় এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৮ ধারাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে গ্রেফতার পূর্ব জামিনের ব্যাপারে বিভিন্ন নজীর (Ruling) এসেছে। এ বিশেষ ক্ষমতা দায়রা আদালত এবং হাইকোর্ট বিভাগ প্রয়োগ করে থাকেন। কোনো ম্যাজিষ্ট্রেট এ ধরণের আগাম জামিন দিতে পারেন না।
আগাম জামিন মঞ্জুরের সত্যতা প্রতিপাদন করতে দরখস্তকারীকে দেখাতে হবে যে, সে গ্রেফতার হতে পারে মর্মে আশংকা করছে অথবা দরখাস্তকারীর সুনাম ও স্বাধীনতার অপূরনীয় ক্ষতি করার বিদ্বেষে প্রসিকিউশন প্ররোচিত হয়েছে অথবা পুলিশ রাজনৈতিক বিবেচনায় বা অন্য কোনো কারণে প্ররোচিত হয়েছে (পিএলডি (১৯৮৩) এসসি ৮২)।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৬ ও ৪৯৭ ধারায় যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে সংশ্লিষ্ট সকল আদালতই জামিনের আবেদন গ্রহণ করতে পারেন এবং এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৮ ধারার বিধান অনুসারে একমাত্র হাইকোর্ট বিভাগ এবং দায়রা আদালতই গ্রেফতারের পূর্বে জামিনের আবেদন গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। সুতরাং দেখা যায় যে, গ্রেফতারের পূর্বে জামিনের জন্য হারকোর্ট বিভাগ বা দায়রা আদালতে আবেদন করতে হবে। এ বিষয়ে দায়রা আদালত প্রথম পর্যায়ের আদালত হওয়ায় প্রথম আবেদনটি দায়রা আদালতে দাখিল করা উচিৎ। প্রধানতঃ জামিনের ক্ষমতা হাইকোর্ট এবং দায়রা আদালতে সীমাবদ্ধ এবং অন্যান্য আদালত এর আওতা হতে বাদ যাবে (১৯ ডিএলআর এসসি ৩৯)।
পুলিশ কর্তৃক জামিনঃ
একজন পুলিশ অফিসার ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৭(২), ৫৯(৩), ১৬৯, ১৭০, ৪৯৬ ও ৪৯৭ ধারা অনুসারে আদালতের বা ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমতি ব্যতিরেকে আসামীকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন।
ফৌজদারী কার্যবিধি ৫৭(২) ধারাঃ
যেক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি কোনো আমলের অযোগ্য অপরাধ করে অথবা এরূপ অপরাধ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় সেক্ষেত্রে পুলিশ অফিসার তার প্রকৃত নাম ও ঠিকানা পাওয়া গেলে প্রয়োজনবোধে ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হাজির হওয়ার উদ্দেশ্যে জামিনদারসহ বা জামিনদার ব্যতীত মূচলেকা সম্পাদনের পর তাকে ছেড়ে দিতে পারেন। তবে এ ব্যক্তি বাংলাদেশের বাসিন্দা না হলে এক বা একাধিক বাংলাদেশের বাসিন্দাকে তার মূচলেকার জামিনদার হতে হবে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৯(৩) ধারাঃ
কেহ আমলের অযোগ্য অপরাধ করেছে বলে বিশ্বাস করার কারণ থাকলে এবং পুলিশ অফিসারের দাবীর পর সে নিজের নাম ও ঠিকানা দিতে অস্বীকার করলে অথবা এরূপ নাম ও ঠিকানা দেয়া হয় যা উক্ত অফিসারের মিথ্যা বলে বিশ্বাস করার কারণ ঘটে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৭ ধারা অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সে কোনো অপরাধ করেছে বলে বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট কারণ না থাকলে তাকে তাৎক্ষণাৎ ছেড়ে দিতে হবে।
ফৌজদারী কার্যবিধি ১৬৯ ধারাঃ
তদন্তের পর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তদন্তকারী পুলিশ অফিসারের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, আসামীকে ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরণের যৌক্তিকতা দেখানোর মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য বা সন্দেহের যুক্তিসংগত কারণ নেই, তাহলে উক্ত অফিসার আসামী হেফাজতে থাকলে অফিসারের নির্দেশ অনুযায়ী জামিনদারসহ বা জামিনদার ব্যতীত একটি মূচলেকা সম্পাদনের পর এ শর্তে তাকে মুক্তি দিবেন যে, মূচলেকা অনুসারে যদি কখনও প্রয়োজন হয় তাহলে তখন আসামী পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে অপরাধটি আমলে নেয়ার এবং আসামীর বিচার বা তাকে বিচারার্থে প্রেরণ করার ক্ষমতাবান কোনো ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হাজির হবে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭০ ধারাঃ
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য রয়েছে তবে তিনি আসামীকে আমল গ্রহণকারী ম্যাজিঢট্রেটের নিকট প্রেরণ করবেন অথবা অপরাধ জামিনযোগ্য হলে এবং আসামী জামানত দিতে সম্মত হলে কোনো নির্ধারিত দিনে উক্ত ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হাজির হওয়া এবং অন্যরূপ নির্দেশ না হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দিনে হাজির হওয়ার জন্য তার নিকট হতে জামিন গ্রহণ করবেন।
জামিন সম্পর্কিত উচ্চতর আদালতের সিদ্ধান্ত সমূহঃ
(১) ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন মামলার আসামীকে দায়রা আদালতে জামিন মঞ্জুর করলে এবং পরবর্তীকালে প্রয়োজন হলে ম্যাজিষ্ট্রেট উক্ত জামিন বাতিল করতে পারেন (১৬ ডিএলআর ৩২৫)।
(২) আসামীকে আটক রাখার চেয়ে জামিনে মুক্তি দিলে যদি অভিযোগকারীর কল্যাণ সাধিত হয় তাহলে জামিনে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। যেক্ষেত্রে বিদেশে চাকুরী দেয়ার জন্য অভিযোগকারীর নিকট হতে অর্থ গ্রহণ করেছিল, সেক্ষেত্রে আসামীকে হাজতে আটক রাখা হলে বিদেশে গমনেচ্ছুক ব্যক্তির সমস্যার সমাধান হবে না। আবেদনকারী আসামী জামিনে মুক্ত থাকলে অভিযোগকারীর সহায়তা হতে পারে এবং আসামী অভিযোগকারীকে বিদেশে পাঠানোর জন্য আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে এবং বস্তুতঃ জামিনের আবেদনকারী আসামী কর্তৃক তাকে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরণ করতে পারেন (১৯৮০ সিআরএলজে ১০১৭)
(৩) অভিযুক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে দন্ডনীয় অপরাধ করেছে মর্মে যদি যুক্তিসংগত কারণ না থাকে তাহলে জামিন মঞ্জুর করা যায় (২০ ডিএলআর ৪৬ এসসি)।
(৪) পালন অযোগ্য শর্ত আরোপ জামিন অস্বীকার করারই শামিল। এরূপ অসম্ভব শর্ত আরোপের চেয়ে জামিন অস্বীকার করাই আদালতের জন্য যুক্তিসংগত (৩৩ ডিএলআর ১৪৫)।
(৫) বিচার অনুষ্ঠানে অনাহুত বিলম্ব জামিন মঞ্জুরের বৈধ কারণ হবে এবং এরূপক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুরের প্রশ্নটি সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে হবে (২০ ডিএলআর ৩৩৯ এসসি)।
(৬) বাদীপক্ষ যদি জামিন বাতিলের জন্য আবেদন করে তাহলে বাতিল করণের বহুপূর্বে আসামীর উপর নোটিশ জারী করতে হবে যাতে আসামী আদালতে তার বক্তব্য রাখতে সক্ষম হয় (২০ ডিএলআর ৩৯৯)।
(৭) আবেদনকারীর শিক্ষাগত পূর্ব ইতিহাসস যদি ভালো থাকে তাহলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদানের জন্য জামিন মঞ্জুর করা যায় (৪০ ডিএলআর ১৪৪)।
(৮) জামিন বাতিলের জন্য আবেদন করা হলে জামিন বাতিলের বহুপূর্বে আসামীর উপর নোটিশ জারী করতে হবে যাতে আসামী আদালতে তার বক্তব্য রাখতে সক্ষম হয় (২০ ডিএলআর ৩৩৯ এসসি)।
(৯) একই আদালতে দ্বিতীয় জামিনে দরখাস্ত গ্রহণ করা উচিৎ নয় যদি আগের আদেশ রহিত করার জন্য নতুন কোনো কারণ তৈরী করতে না পারে (১০ ডিএলআর ৪৫২)।
(১০) আসামী জামিনে গেলে সাক্ষীদের স্বাধীনভাবে সাক্ষ্য প্রদান করতে দিবে না এমন অনিশ্চিত অভিযোগের উপর জামিনের আবেদন প্রত্যাখান করা উচিৎ হবে না। অন্যদিকে আসামী জামিনে গেলে যদি সাক্ষীদের ভয় দেখানোর সম্ভাবনা থাকে তাহলে ম্যাজিষ্ট্রেট জামিনের আবেদন প্রত্যাখান করলেই ভালো করবেন (২২ বোম্বে ৫৩৯)।
(১১) আসামী বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কোনো অসুখ না থাকলে বয়সের অজুহাতে জামিন পেতে পারে না। আসামী ৮৫ বৎসর বয়স্ক এবং অসুস্থ কিন্তু তাকে ডাক্তারী পরীক্ষা করা হয়নি এবং জামিনের আবেদনে অসুস্থতার প্রকৃতি বর্ণিত না হওয়ায় কেবল বয়সের অজুহাতে জামিন মঞ্জুর করা যায় না (পিএলডি ১৯৭১ লাহোর ১৯৬)।
(১২) জামিন মঞ্জুরের নীতি যদিও বিবেচনামূলক তবুও ন্যায় পরায়নতার সাথে উহা প্রয়োগ করতে হবে (৩৫ ডিএলআর ২৯ এডি)।
(১৩) জামিন অযোগ্য মামলার ক্ষেত্রে জামিনযোগ্য গ্রেফতারী পরোয়ানা ইস্যু করা যায় (১২ সিআরএলজে ৪৩০)।
(১৪) একজন আর্মি অফিসারের আদেশে জামিন বাতিল করা এবং তৎপ্রেক্ষিতে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা বে-আইনী (৩৩ ডিএলআর ৩৮)।
(১৫) ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৯ ধারার কোথাও নগদ জামানতের কথা বলা হয়নি। ফৌজদারী কার্যবিধি ৫১৩ ধারায় কতিপয় নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আসামী প্রস্তাব দিলে বন্ডের পরিবর্তে জামানত হিসাবে নগদ টাকা গ্রহণের ক্ষমতা আদালতকে দিয়েছে (৩৩ ডিএলআর ১৪৬)।
(১৬) জামানত হিসেবে আদালত ব্যাংক গ্যারান্টি চাইতে পারেন না (১৯৬০ পিসিআরএলজে ৩২৩)।
(১৭) এজাহারের বক্তব্য এবং মেডিক্যাল সাক্ষ্যের মধ্যে অসামঞ্জস্য অথবা মৌখিক সাক্ষ্য এবং মেডিক্যাল সাক্ষ্যের মধ্যে অসামঞ্জসের কারণে জামিন মঞ্জুর করা যায়(১৯৭০ পিসিআরএলজে ১৮০ লাহোর)।
(১৮) উচ্চ মর্যাদার চাকুরী জামিন মঞ্জুরের কোনো কারণ হতে পারে না কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের বিধান অনুসারে সকলেই আইনের চোখে সমান এবং সকলেই আইনের বিধান অনুসারে একই রকম ব্যবহার পেতে পারে (৩২ ডিএলআর ১৬৯)।
(১৯) যেহেতু আসামীকে এক বৎসরের বেশী কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় সেহেতু ফৌজদারী কার্যবিধির ৪২৬ ধারার বিধান অনুসারে দায়রা জজ জামিন মঞ্জুর করতে উপযুক্ত ছিলেন না (৪০ ডিএলআর ২৮১)।
(২০) জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট সম্পাদিত জামিননামা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট বাজেয়াপ্ত করতে পারেন না (ডিএলআর ২৮ ডব্লিউপি)।