⚖️ সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল কি?

  • Author: MD Sirajul Islam, Inspector of Police
  • Published: 14 hours ago
  • Category: অপরাধ বিজ্ঞান

সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল নির্ধারণের সময় তাদের মনস্তত্ত্ব ও মানসিক গঠন গভীর বিবেচনায় নেয়া দরকার। এজন্য তদন্তকারীর আধুনিক সাক্ষ্য মনস্তত্ত্ব, অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব ও সমাজ মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে চলনসই জ্ঞান থাকা আবশ্যক। প্রত্যক্ষ সাক্ষীই ফৌজদারী বিচারে সেরা; কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে প্রতিটি মানুষই যা পর্যবেক্ষণ করে তা নির্ভুলভাবে বলতে বা লিখতে পারে না। স্মৃতিশক্তির মান, মানসিক সুস্থতা ও প্রত্যক্ষণের ধরন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে কোনো ব্যক্তি কতো নির্ভুলভাবে নিজের স্মৃতিভান্ডার থেকে তার অভিজ্ঞতা অন্যকে বলতে পারবে। প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য বলতে বুঝায়-

(১) সাক্ষী যা চোখে দেখেছে,

(২) সাক্ষী যা কানে শুনেছে,

(৩) সাক্ষী যা নাকে গন্ধ পেয়েছে, 

(৪) সাক্ষী যা ত্বক দ্বারা অনুভব করেছে এবং

(৫) সাক্ষী যা জিহ্বা দ্বারা স্বাদ পেয়েছে। 

 

মানুষ পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা বহিঃজগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞান মস্তিস্কে সংযোজন-বিয়োজন ও পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনার পর বিষয় সম্পর্কে ধারণা জন্মায়। মানসিক গঠন ও পর্যবেক্ষণে অবহেলা ইত্যাদি কারণে প্রত্যক্ষণ প্রাপ্ত জ্ঞানেও ভ্রান্তি আস্তে পারে। তাছাড়া ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ, অলীক দর্শন ও অলীক বিশ্বাস মনোব্যধি ও মনোবিকারগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাতে থাকে, যা প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা। তদন্তকারীকে শুধু সাক্ষ্য সংগ্রহ করলেই চলে না, তাকে সাক্ষ্যের বস্তুনিষ্ঠতা নিরূপণ করতে হয় এবং মামলার কোন বিচার্য বিষয় তা প্রমাণ করবে তা নির্ধারণও প্রয়োজন। সংঘটিত অপরাধের সত্যতা উদঘাটন, অপরাধীরকে সনাক্তকরণ, অপরাধের মোটিভ নির্ণয় এগুলোর জন্য তদন্তকারী সবচেয়ে নির্ভর করেন সাক্ষীর বক্তব্যের উপর। তাই প্রত্যেকটি সাক্ষ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গ্রহণ করা উচিৎ; নতুবা তদন্ত বিপদে চালিত হবার সম্ভাবনা থাকে। 

 

যদিও কিছু কিছু সাক্ষীকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করা প্রয়োজন হতে পারে, তথাপি সর্বজন স্বীকৃত নিয়ম হলো সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদে ধৈর্য ও সহানুভূতিমূলক আচরণকে প্রধান্য দিতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদকারীর অন্যতম সমস্যা হলো সাক্ষী কি স্বেচ্ছায় বা সচেতনভাবে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে কিংবা তথ্য গোপন করছে এটা নির্ধারণ। প্রায়শই তদন্তে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অসদুদ্দেশ্য ব্যতিরেকেই কোনো কো্নো সাক্ষী ভূল তথ্য প্রদান করে। স্বল্পবুদ্ধি, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, অশিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, লাজুকতা, জড়তা ইত্যাদি কারণে অসচেতনভাবে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেয়। নিজে যা প্রত্যক্ষ করেনি, অন্যের কাছে জেনেছে তাও নিজের প্রত্যক্ষণ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে কেউ কেউ। এছাড়াও সাক্ষীরা নিম্নক্ত কারণে মিথ্যা তথ্য দেয় কিংবা বলে যে ঘটনার কোনো কিছুই জানে নাঃ 

(১) আসামীর সুহৃদ বা বন্ধু; তার অমঙ্গল চায় না।

(২) আসামীর সঙ্গে আত্মীয়তা রয়েছে।

(৩) আসামীর সঙ্গে ব্যবসা-বানিজ্য আছে।

(৪) আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার ঝামেলা বা লোকজন তাকে এভাবে জানুক তা চায় না।

(৫) আদালতে যাওয়া মানে নিজের কাজের ক্ষতি করা। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো-এমন ভাবার কারণে। 

(৬) পুলিশের প্রতি ভালো ধারণা নেই, তাই কিছু বলতে রাজি নয়। 

(৭) আসামী বা তার আত্মীয়-স্বজনের দিক থেকে প্রতিশোধ আশংকা রয়েছে। 

(৮) সাক্ষী নিজেই আসামীর সহযোগী, তাই কেঁচো খুঁরতে গিয়ে সাপ বের না হয় ইত্যাদি।  

 

সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদের কৌশলঃ 

সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তদন্তকারী খানিকটা সন্দেহের ভাব দেখাবেন। এমনকি যদি প্রতীয়মান হয়, সাক্ষী যথার্থই সত্য কথা বলছে, তবুও তিনি সন্দেহভাব বজায় রাখবেন। সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদের উত্তম স্থান হলো ঘটনাস্থল বা ঘটনা সংলগ্ন কোনো জায়গা। কারণ ঘটনার সত্যতা এবং কোনো বিষয়ের খুটিনাটি তাৎক্ষণিক যাচাইয়ের সুবিধার পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক কারণে সাক্ষীর সক্রিয় সাড়া পাওয়া যায়। ঘটনার জলজ্যান্ত উপস্থিতি তার মানসে সংশ্লিষ্ট বিষয় অস্বীকার বা বিকৃত হবার প্রবণতার পক্ষে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদের কৌশলগুলি হলো-  

(১) প্রথমে সাক্ষীকে তার নিজের মতো করে ঘটনা বলতে দেওয়া। 

(২) বর্ণনাতে বাধা দিতে নেই, একটানা বলার সুযোগ দিতে হবে। 

(৩) বক্তব্য শেষে সতর্ক প্রশ্নের দ্বারা কোনো বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হবে।

(৪) সাক্ষীর জবানবন্দী বাস্তবে যাচাই করতে হবে, অসঙ্গতি থাকলে সাক্ষীকে বলতে হবে এবং ব্যাখ্যা চাইতে হবে। 

(৫) যদি মনে হয় সাক্ষীর স্মৃতি দুর্বল ও বিভ্রান্তিমূলক, তবে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে প্রশ্ন করে সাক্ষীর স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করতে হবে। কোনো বিষয়ে মনে করতে সমর্থ না হলে তাকে সাহায্য করতে হবে যেমন- ঘটনার সময়, আগে পরে কখন কি করেছিল সাক্ষী? এভাবে প্রশ্ন করা হলে সঠিক সময়ে সে স্মরণ করতে পারে। 

(৬) প্রত্যক্ষ সাক্ষীকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। 

 

যদিও সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা ও তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার জন্য তদন্তকারী খুব বেশি সমস্যায় পড়েন না, তথাপি এমন সাক্ষীর দেখা মেলা অসম্ভব নয় যে জ্ঞাত তথ্য গোপন করতে চায়; পুলিশের নিকট মুখ কুলতে চায় না কিংবা মিথ্যা তথ্য প্রদান করে। সাক্ষীর এমন আচরণের বহু রকম কারণ থাকতে পারে, তবে অন্যতম হেতু হলো সাক্ষী নিজেই হয়তো ইতোপূর্বে অপরাধ করেছে, অপরাধীর প্রতি সহানুভূতিশীল, তার সহযোগী কিংবা অপরাধীর দিক থেকে প্রতিশোধ আশংকায় ভীতসন্ত্রস্ত। 
Google News Google News
Google News এ বিরাট বাজারের সকল পোস্ট পেতে ক্লিক করে ফিডটি ফলো করুন