⚖️ চুড়ান্ত প্রতিবেদন বা Final Report কি?
- Author: MD Sirajul Islam, Inspector of Police
- Published: 1 week ago
- Category: ফৌজদারী কার্যবিধি
যখন কোনো মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষে এজাহারভুক্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট অপরাধ সংঘটনের সাথে জড়িত থাকার কোনো তথ্য পাওয়া না যায় তখন তদন্তকারী কর্মকর্তা চুড়ান্ত প্রতিবেদন বা Final Report আদালতে দাখিল করিয়া থাকেন। পিআরবি ২৭৫ বিধান অনুযায়ী চুড়ান্ত প্রতিবেদন পাঁচ প্রকার হইয়া থাকে। যেমন-
(১) চুড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য (Final Report true, FRT:
এইক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হইয়াছে ঠিকই কিন্তু কার দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হইয়াছে এই সম্পর্কে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নাই বা আসামীদের সম্পর্কে কোনো তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয় নাই।
(২) চুড়ান্ত প্রতিবেদন মিথ্যা (Final Report False, FRF):
এইক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে কোনো ঘটনাই সংঘটিত হয় নাই, কিন্তু সংবাদদাতা কাউকে ফাসানোর জন্য সুপরিকল্পিতভাবে একটা ঘটনা সাজাইয়া মিথ্যা মামলা দায়ের করিয়াছেন। সংবাদদাতা কর্তৃক মিথ্যা মামলা দায়ের করার কারণে তদন্তকারী কর্মকর্তা তাহার বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ২১১ ধারা মোতাবেক নন-এফআইআর প্রসিকিউশন দাখিল করার জন্য আদালতের নিকট আবেদন করিতে পারেন। মামলাটি যদি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের হয় তাহা হইলে একই আইনের ১৭ ধারা মোতাবেক বাদী বা সংবাদদতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।
(৩) চুড়ান্ত প্রতিবেদন তথের ভূল (Final Report Mistake of fact FRMF):
তথ্যগত ভুলের জন্য এই ধরণের চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হইয়া থাকে। এইক্ষেত্রে দন্ডবিধির ৩৭৬ ধারা অথবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারা অর্থাৎ ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করা হইয়াছিল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটিয়াছিল যাহা দন্ডবিধি ৩৫৪ ধারা বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারার অপরাধের পর্যায় পড়ে।
(৪) চুড়ান্ত প্রতিবেদন আইনের ভূল (Final Report Mistake of Law, FRML):
যখন মৃত্যু বা গুরুত্বর আঘাতের ভয় দেখাইয়া সম্পত্তি আদায় করা হইয়াছে মর্মে অভিযোগ দায়ের করা হয় কিন্তু সম্পত্তিটি চুরি করিয়াছে মর্মে থানার রেকর্ডিং অফিসার তাহা রেকর্ড করেন, তখন চুড়ান্ত প্রতিবেদন আইনের ভূল বুঝাবুঝি দাখিল করা হয়।
(৫) চুড়ান্ত প্রতিবেদন অধর্তব্য বা অ-আমলযোগ্য (Final Report Non-cognizable, FRNon-cog):
ধরা যাক দন্ডবিধির ৩২৬ ধারার মামলা দায়ের করা হইয়াছিল কিন্তু তদন্তকালে দন্ডবিধির ৩২৩ ধারার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। যেহেতু দন্ডবিধির ৩২৩ ধারার অপরাধ অধর্তব্য বা অ-আমলযোগ্য দাখিল করিয়া থাকেন। এইক্ষেত্রে কোনো পুলিশ অফিসার আদালতের পূর্বানুমতি নিয়া দন্ডবিধির ৩২৩ ধারায় নন-এফআইআর প্রসিকউশন আদালতে দাখিল করিতে পারেন।
চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর আদালত সন্তোষ্ট হইলে ফৌজদারী কার্যবিধির ২০২ (২খ) ধারা অনুযায়ী চুড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করিয়া আসামীকে অব্যাহতি দিবেন।
চুড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে সংবাদদাতা বা বাদী আদালতে নারাজীর দরখাস্ত দাখিল করিলে আদালত নথিপত্র, কেস ডায়রী, নারাজীর দরখাস্ত ইত্যাদি বিশ্লেষণ করিয়া যদি দেখেন যে, তদন্তকারী কর্মকর্তার চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল না করিয়া অভিযোগপত্র দাখিল করা উচিৎ ছিল, সেইক্ষেত্রে আদালত তিন ভাবে অগ্রসর হইতে পারেন-
(১) বাদীকে ফৌজদারী কার্যবিধির ২০০ ধারার হলফান্তে পরীক্ষা করিয়া অপরাধ আমলে নিতে পারেন এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ২০৪ ধারায় আসামীর বিরুদ্ধে প্রসেস ইস্যু করিতে পারেন। এইক্ষেত্রে মামলাটি সিআর মামলায় রুপান্তরিত হইবে।
(২) ফৌজদারী কার্যবিধির ২০২ ধারা অনুসারে আদালত নিজেই মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত করিতে পারেন অথবা অধঃস্তন কোনো ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য প্রেরণ করিতে পারেন। বিচার বিভাগীয় তদন্তে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হইলে মামলাটি আমলে নিয়া ফৌজদারী কার্যবিধির ২০৪ ধারায় আসামীর বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারী করিতে পারিবেন। এইক্ষেত্রেও মামলাটি সিআর মামলায় রুপান্তরিত হইবে।
(৩) ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭৩(৩)(খ) ধারা অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিষয়গুলি উল্লেখ করিয়া আদালত আরও তদন্তের (Further Investigation) জন্য মামলাট থানায় প্রেরণ করিতে পারেন। তবে যে পুলিশ কর্মকর্তা পূর্বে তদ্ন্ত প্রতিবেদন অর্থাৎ চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করিয়াছিলেন তাহার চেয়ে একজন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত করিয়া প্রতিবেদন দাখিল করিবেন মর্মে আদেশ দেওয়াই শ্রেয়, কারণ যে পুলিশ কর্মকর্তা পূর্বে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করিয়াছেন তাহার নিকট আরও তদন্তের জন্য পাঠাইলে পূর্বের মতোই চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করার সম্ভাবনাই বেশী থাকে। সিআইডিকেও মামলাটি তদন্ত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া যাইতে পারে। তবে এইক্ষেত্রে তদন্তের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে আদেশের কপি অতিরিক্ত মহা-পুলিশ পরিদর্শক, সিআইডি এর নিকট প্রেরণ করিতে হইবে।
উচ্চতর আদালতের সিদ্ধান্ত সমূহঃ
(১) পুলিশ কর্তৃক দাখিলকৃত চুড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে একজন সংবাদদাতা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট নারাজী দরখাস্ত দাখিল করিতে পারেন এবং ম্যাজিষ্ট্রেট সেই নারাজী দরখস্তটিকে নালিশের দরখাস্তরূপে গণ্য করিয়া ফৌজদারী কার্যবিধির ১৯০(১)(ক) ধারায় উহা আমলে নিতে পরেন এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ২০০ ধারার হলফী জবানবন্দী গ্রহণ করিতে পারেন (২৭ ডিএলআর ১১১)।
(২) পুলিশ আসামীর বিরুদ্ধে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করিলেও ম্যাজিষ্ট্রেট বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য নির্দেশ দিতে পারেন এবং সেই তদন্তে নালিশকারী সাক্ষ্য প্রদান করিলে ম্যাজিষ্ট্রেট মামলা আমলে নিতে পারেন (২৯ ডিএলআর ২৫)।
(৩) পুলিশ আসামীর বিরুদ্ধে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর ম্যাজিষ্ট্রেট কর্তৃক তাহা গৃহীত হইয়াছে কিন্তু পূনরায় সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে মর্মে পুলিশ তদন্তের আবেদন করিলে ম্যাজিষ্ট্রেট অনুমতি প্রদান করিতে পারেন (২৯ ডিএলআর ২৫৬)।
(৪) চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পরও অভিযোগপত্র দাখিলের ক্ষমতা পুলিশের রহিয়াছে (১৪ ডিএলআর ৫১১)।
(৫) যদি ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট চুড়ান্ত প্রতিবেদন সন্তোষজনক না হয় তাহা হইলে তিনি যাহার অনুকুলে চুড়ান্ত প্রতিবেদন প্রদান করা হইয়াছে সেই আসামীর বিরুদ্ধে অপরাধটি আমলে নেওয়ার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন ম্যাজিষ্ট্রেট ঐ সময় অপরাধটি আমলে না নিলেও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যদি পরবর্তীতে কোনো অপরাধ প্রকাশ হইয়া পড়ে তাহা হইলে তিনি আসামীর বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিতে পারেন (৪ বিএলডি ২০৬ এডি)।
(৬) নালিশের আবেদন খারিজ বা আসামীর অব্যাহতি, খালাসের মতো এক জিনিষ নহে। খালাসের পর নতুন অভিযোগ হইতে পারে না। ফাইনাল রিপোর্ট গৃহীত হইবার পর নতুন নালিশ যদিও আইনে অনুমতিযোগ্য তবুও ব্যতিক্রমধর্মী কারণ ব্যতীত তাহা গ্রহণ করা যায় না (৩৬ ডিএলআর ৫৮ এডি)।
(৭) ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করিলে এজাহারকারী উহার বিরুদ্ধে নারাজীর দরখাস্ত দাখিল করিতে পারেন এবং ম্যাজিষ্ট্রেট উক্ত দরখাস্তকে নালিশের আবেদন বিবেচনা করিয়া ফৌজদারী কার্যবিধির ১৯০(১)(ক) ধারার অপরাধ আমলে নিতে পারেন এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ২০০ ধারায় দরখাস্তকারীকে পরীক্ষা করিতে পারেন (২৭ ডিএলআর ১১১)।
(৮) তদন্তকালে পুলিশ এজাহারে উল্লিখিত অপরাধ ব্যতীত অন্য কোনো অপরাধের সন্ধান পাইলে, সেই অপরাধ সংক্রান্ত রিপোর্ট দাখিল করিতে পুলিশের কোনো বাধা নাই (১৯ ডিএলআর ৪৩৯ এসসি)।
(৯) পুলিশ আসামী ও অন্যান্য কয়েকজনের বিরুদ্ধে যথাক্রমে অভিযোগপত্র ও চুড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে। ম্যাজিষ্ট্রেট পুলিশ রিপোর্ট গ্রহণ পূর্বক চুড়ান্ত রিপোর্টে উল্লিখিত ব্যক্তিগণকে অব্যাহতির আদেশ দেন। পরবর্তীতে বাদী কর্তৃক পেশকৃত নারাজী দরখস্তের ভিত্তিতে ম্যাজিষ্ট্রেট পুলিশকে পূর্বে অব্যাহতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণসহ সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধে গুরুত্বর অপরাধের অভিযোগে অতিরিক্ত অভিযোগপত্র দাখিলের নির্দেশ দেন। ম্যাজিষ্ট্রেটের এইরূপ নির্দেশ অবৈধ বা বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে (৩৫ ডিএলআর ৪২৫)।
(১০) অভিযোগপত্র দাখিল করার পর পুলিশ একই ঘটনার উপর পূণরায় তদন্ত করিয়া চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করিতে পারেন না (৩৬ ডিএলআর ১৫৬)।