⚖️ অপরাধ বিজ্ঞান কিভাবে তদন্তকারী অফিসারকে সাহায্য করিতে পারে?
- Author: MD Sirajul Islam, Inspector of Police
- Published: 2 weeks ago
- Category: অপরাধ বিজ্ঞান
অপরাধ বিজ্ঞান অপরাধ ও অপরাধীদের সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা ও পর্যালোচনা করিয়া থাকে। অপরাধীদের কৃতকর্মের পদ্ধতি ও কলাকৌশল সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আধুনিক পদ্ধতিতে তদন্তকারী অফিসারকে বিভিন্ন মামলা তদন্তে সাহায্য করিতে পারে। অপরাধ ও অপরাধীদের সনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে অপরাধ বিজ্ঞান পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি নানান বিদ্যার আলোকে বিজ্ঞানভিত্তিক নানা আধুনিক পদ্ধতি, কৌশল, যন্ত্রপাতি ও ব্যবহারিক জ্ঞান প্রয়োগের ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল তদন্তকারী অফিসারকে যথা সময়ে সরবরাহ করিয়া তদন্তকাজে প্রভূত সাহায্য ও দিক নির্দেশনা প্রদান করিতে পারে।
অপরাধের কার্যক্রমের ভিত্তিতে বিভিন্ন গবেষণাগারে প্রাপ্ত আলামত বা বস্তুসাক্ষ্য এর উপর বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়া পরীক্ষালব্ধ ফলাফল তদন্তকারী অফিসারকে যথাসময়ে প্রদান করিলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী অফিসার প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্বের ভিত্তিতে সঠিক পথে তদন্ত পরিচালনা করিয়া অপরাধ ও অপরাধীকে সহজেই সনাক্ত করিতে পারে। তবে আলামত বা বস্তুসাক্ষ্য সঠিভাবে সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং সতর্কতার সহিত গবেষণাগারে সঠিক পদ্ধতিতে প্রেরণ পূর্বক ঠিক কি কি বিষয়ে মতামত বা সিদ্ধান্ত প্রয়োজন, তাহা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করিতে হইবে।
বিভিন্ন বস্তুসাক্ষ্য সম্পর্কে পরীক্ষাগার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পরীক্ষাগার হইতে প্রেরিত তথ্য ও তত্বের ভিত্তিতে একজন তদন্তকারী অফিসার কিভাবে সাহায্য পাইতে পারেন, তাহা নিম্নে উল্লেখ করা হইলঃ
(ক) গোপন বা অদৃশ্য লেখাঃ
গোপন বা অদৃশ্য লেখা সম্বলিত কোনো কাগজ বা দলিল পরীক্ষাগারে প্রেরণ করা হইলে পরীক্ষক উক্ত কাগজের উপর অতি বেগুনী রশ্মি অথবা অবলোহিত রশ্মি প্রয়োগ করিয়া কাগজ বা দলিলের লেখা পাঠ উদ্ধার করিয়া তদন্তকারী অফিসারকে সাহায্য করিতে পারে।
(খ) কাপড়-চোপড় বা বস্ত্র খণ্ডঃ
তদন্তকালে ঘটনাস্থল হইতে বা পরে সন্দেহমূলে কোনো কাপড়-চোপড় বা বস্ত্রখণ্ড জব্দ করিয়া পরীক্ষাগারে প্রেরণ করা হইলে উক্ত কাপড়-চোপড় বা বস্ত্র খণ্ডের উপর অতি বেগুনী রশ্মি অথবা অবলোহিত রশ্মি প্রয়োগ করিয়া পরীক্ষক জব্দকৃত বস্তুসাক্ষ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধীর যোগসূত্র স্থাপনার্থে সুনির্দিষ্ট মতামত প্রদান করিতে পারে। ইহাতে সাদৃশ/বৈসাদৃশ্য ধরা পড়িবে।
(গ) অনুরূপ কোনো কাপড়, কাগজ ইত্যাদিতেও কোনো রক্তের দাগ, বীর্যের দাগ, রক্তের দাগ সনাক্তকরণে সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য চিহ্নিত করণে অতি বেগুনী রশ্মি অথবা অবলোহিত রশ্মি নিজ নিজ আলোর বর্ণালি প্রকাশ করিয়া তদন্তকারী অফিসারকে সাহায্য করিতে পারে।
(ঘ) সরকারি দলিলপত্র বা বেসরকারি দলিলপত্রে অতিরিক্ত কালী থাকিলে, উপরী লেখা (Over Writing) থাকিলে, ঘষামাজা লেখা থাকিলে অতি বেগুনী রশ্মি অথবা অবলোহিত রশ্মি পয়োগ করিয়া পূর্বের লেখা উদ্ধার করা যায়। ফলে তদন্তকারী অফিসার সহজে অপরাধীকে চিহ্নিত করিতে পারে।
(ঙ) বন্ধ খামের চিঠিঃ
তদন্ত কাজের সুবিধার জন্য বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো সীল করা খামের ভিতরের বিষয়বস্তু খাম না খুলিয়াই দেখার প্রয়োজন হইলে উক্ত খামের উপর অবলোহিত রশ্মি প্রয়োগ করিয়া ছবি উঠাইয়া পত্রের বিষয়বস্তু জানা সম্ভব হয়।
(চ) একটি মুক্তার দানা অবলোহিত রশ্মিতে পরীক্ষা করিলে আসল মুক্তার ক্ষেত্রে দানার ছবি ছোট এবং কৃত্রিম দানার ছবি বৃহত্তর দেখাইবে।
(ছ) গাড়ীর চাকার দাগঃ
মোটর দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকালে গাড়ির চাকার দাগের ফটোগ্রাফ পরীক্ষাগারে প্রেরণ করা হইলে পরীক্ষক তুলনামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট গাড়ি সনাক্ত করিতে তদন্তকারী অফিসারকে সাহায্য করিতে পারে।
(জ) পায়ের ছাপঃ
তদন্তকালে তদন্তকারী অফিসার ঘটনাস্থল হইতে প্রাপ্ত পায়ের ছাপের ফটোগ্রাফ, ট্রেসিং অথবা মোল্ড সংগ্রহ করিয়া সন্দিগ্ধ ব্যক্তির পায়ের ছাপ প্রেরণ করিলে পরীক্ষক সেইগুলি পরীক্ষা করিয়া ছাপের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির একান্ত স্বতন্ত্র সূচক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করিয়া তদন্তকারী অফিসারকে সাহায্য করিতে পারে।
(ঝ) যন্ত্রপাতির দাগঃ
কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে ব্যবহূত যন্ত্রপাতির সহিত তুলনামূলক পরীক্ষা করাইলে অনুবিক্ষণ যন্ত্রে অনুবিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক তথ্য জানা যায়।
(ঞ) এক্সরে ও রেডিওগ্রাফিঃ
তদন্ত কাজে এক্সরে ব্যবহূত হয় রেডিওগ্রাফির মাধ্যমে। কাহারো পেটে (পাকস্থলীতে) হিরোইনের প্যাকেট বা স্বর্ণের, হীরার অলংকার বা খণ্ড আছে কিনা তাহা রেডিওগ্রাফি চিহ্নিত করিতে পারে। এক্সরে দ্বারা বস্ত্র, আশ, কাগজ, চামড়া, কৃত্রিম বা প্রাকৃতিক পাথর এর তুলনামূলক বিচার করা যায়। তাছাড়া এক্সরে দ্বারা বীজ, পাতা, পোকা-মাকড় এরও তুলনামূলক বিচার বিশ্লেশণ সম্ভব হয়। যা তদন্ত কাজে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করিতে পারে। অন্য দিকে এক্সরে ডিফ্লেকশন ধাতব প্রস্তুর পরীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করিয়া থাকে।
(ট) কোনো এক টুকরা কাগজ বা দলিলের অংশ মূল কাগজ বা দলিলের অংশ ছিলো কিনা, তাহা রেডিওস্কোপিক (Stereseopic) ফটোগ্রাফি (ত্রিমাত্রিক ছবি) এর পরীক্ষার দ্বারা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়।
(ঠ) আঙ্গুলের ছাপঃ
আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করিয়া সিআইডি এর ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যুরোতে প্রেরণ করিলে সন্দিগ্ধ ব্যক্তির ছাপের সাথে এর শ্রেণিবিন্যাস, গাণিতিক ফরমূলায় বিচার করিয়া নির্ভুল মতামত দিয়া আঙ্গুলাংক বিশেষজ্ঞ সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন দিতে পারেন। যাহা অপরাধ তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করিয়া থাকে।
(ড) হস্তলিপিঃ
নমুনা হস্তলিপি, বিতর্কিত এবং স্ট্যাণ্ডার হস্তলিপি সিআইডি এর হস্তলিপি ব্যুরোতে প্রেরণ করিলে হস্তলিপি বিশারদগণ ফটোগ্রাফি ব্যুরোর সহায়তায় হাতের লেখার বৈশিষ্ট ও অন্যান্য গুণাবলীর প্রেক্ষিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়া হাতের লেখার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য সম্পর্কে সঠিক মতামত দিয়া তদন্তকারী অফিসারকে সাহায্য করিতে পারে।
(ঢ) রাসায়নিক পরীক্ষাঃ
সিআইডি এর রাসায়নিক পরীক্ষাগারে বিভিন্ন বস্তুসাক্ষ্য সম্পর্কে তদন্তকারী অফিসারের চাহিদা মতো রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়া তদন্তকারী অফিসারকে তথ্য সরবরাহ করা হয়। যেমন- ভিসেরা পরীক্ষা করিয়া বিষের অস্তিত্ব নির্ণয় করা হয় এবং রক্তের দাগ বা রক্ত সম্পর্কে রাসায়নিক পরীক্ষায় জানা যায় উক্ত রক্ত মানুষের নাকি অন্য কোনো প্রাণির। তাছাড়া রক্তের গ্রুপিং করিয়া সন্দিগ্ধ ব্যক্তির গ্রুপের সাথে মিলে কিনা সেই মর্মেও মতামত দিয়া রাসায়নিক পরীক্ষক তদন্তকারী অফিসারকে সাহায্য করিতে পারেন।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় তদন্তকালে প্রাপ্ত বস্তুসাক্ষ্য বা আলামতের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষক বা বিশারদ তথ্য প্রদান করিলে তদন্তকারী অফিসার সেই মোতাবেক তদন্ত পরিচালনা করিয়া মামলার ঘটনা উদঘাটন ও আসামী সনাক্ত করিতে পারেন। বিজ্ঞান ভিত্তিক তদন্তের ফলে সংগৃহীত বস্তুসাক্ষ্য ও বিশেষজ্ঞের মতামতের প্রেক্ষিতে আদালত অধিক সংখ্যক অপরাধীকে সাজা প্রদান করিতে সক্ষম হইবে। ফলে সাজার হার বৃদ্ধি পাইবে।