⚖️ আদালত অবমাননার ক্ষেত্র এবং শাস্তির বিধান কি?
- Author: MD Sirajul Islam, Inspector of Police
- Published: 3 weeks ago
- Category: ফৌজদারী কার্যবিধি
-
কেউ যদি আইনতঃ মানতে বাধ্য এমন ধরণের আদালতের কোনো আদেশ, নিষেধ অমান্য করে অথবা অসম্মান করে অথবা আদালতের নিকট কোনো বৈধ প্রতিশ্রুতি ইচ্ছাকৃতভাবে ভংগ করে অথবা এমন ধরণের কোনো আদেশ প্রদান করে যা আদালত অথবা আইন ব্যবস্থার কর্তৃত্বকে অসম্মান করার প্রায়াস পায় অথবা বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমে অবৈধ হস্তক্ষেপ করে অথবা আদালতের অর্তৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করে অথবা আদালত সম্পর্কিত ব্যাপারে কোনো বিচারকের কুৎসা রটনা করে অথবা আদালতের পরিবেশ ও সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে অথবা আদালতের সুষ্ঠু ও নিরবিচ্ছন্ন কর্মকান্ডকে কোনো প্রকার ব্যাহত করে তবে সে আদালত অবমাননা করেছে বলে ধরে নেয়া হবে।
আইনজীবি, পুলিশ, সংবাদপত্রের মালিক, সম্পাদক, মামলার সাথে জড়িত ব্যক্তি বা অন্য কোনো ব্যক্তি তাদের আচরণ ও কর্মকান্ডের দ্বারা আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্থ হতে পারেন।
আদালত অবমাননা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুভাবেই হতে পারে। আদালত অবমাননা আদালতের ভিতরে কৃত কর্মকান্ডের মাধ্যমেও হতে পারে অথবা আদালতের বাহিরেও হতে পারে।
আইনজীবি কর্তৃক আদালত অবমাননাঃ
মামলা শুনানীকালে একপক্ষের আইনজীবি কর্তৃক অন্য পক্ষের আইনজীবির প্রতি অপ্রীতিকর মন্তব্য, দরখাস্তে আদালতের প্রতি নিন্দা সূচক উক্তি করা, আইনজীবি কর্তৃক অসদাচরণ , আদালতের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করা, আদালতের নিরপেক্ষতা ও সততার উপর আঘাত হানা, বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে জনসভায় মতামত প্রকাশ, আদালতের প্রতি ভীতি প্রদর্শন, মামলা স্থানান্তরের দরখাস্তে নিন্দা, কুৎসা ও দুর্নীতির অভিযোগ বর্ণনা করা, আইনজীবি কর্তৃক আদালতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যর্থতা, আপীলে কুৎসাজনক কারণ উল্লেখ করা, অহেতুক আদালত বর্জন করা, জনসভায় বিচারককে ভৎসনা করা, আইনজীবি কর্তৃক বিচারকের হাত হতে দলিল ছিনিয়ে নেয়া ইত্যাদি কর্ম আইনজীবি কর্তৃক আদলত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে।
সংবাদপত্র এবং অন্যান্য লেখা দ্বারা আদালত অবমাননাঃ
বিচারাধীন মামলার ফলাফল প্রভাবান্বিত করার প্রবণতাঃ, মিথ্যা বক্তব্য ছাপানো, রায়ের প্রসংশা অথবা নিন্দা করে কিছু মুদ্রণ করা, বিচারাধীন ফৌজদারী মামলার অভিযুক্ত আসামীকে নির্দোষী মন্তব্য করে সংবাদ পরিবেশন করা, আদালতের কার্যক্রমের ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনা পত্রিকায় ছাপানো ইত্যাদি কার্য আদালত অবমাননার শামিল।
অবস্থা ও পরিস্থিতির কারণে ৩ পদ্ধতিতে আদালত অবমাননার বিচার ও শাস্তি হতে পারেঃ
(ক) ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮০ ধারায় বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করে দন্ডবিধির ২২৮ ধারার কার্যক্রম।
(খ) দন্ডবিধির ২২৮ ধারার কার্যক্রম।
(গ) আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬ অনুসারে কার্যক্রম।
(ক) ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮০ ধারায় বর্ণিত পদ্ধতিঃ
আদালতের দৃষ্টি গোচরে অথবা উপস্থিতিতে আদালত অবমাননার ক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮০ ধারায় বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করে দন্ডবিধির ২২৮ ধারার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আদালত অপরাধীকে হাজতে আটক রাখার ব্যবস্থা করতে পারবেন এবং ঐদিন আদালতের অধিবেশন শেষ হওয়ার পূর্বে যেকোনো সময় অপরাধটি আমলে নিবেন। আদালত যে কার্য্যে রত ছিলেন সেই বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমের প্রকৃতি এবং উহার যে পর্যায়ে আদালত বাধাপ্রাপ্ত বা অপমানিত হয়েছেন তা এবং উক্ত বাধা বা অবমাননার প্রকৃতি নথিতে উল্লেখ করতে হবে এবং একটি আলাদা নথিতে মিস মামলার কার্যক্রম গ্রহণ ও শেষ করবেন। তবে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আদালত কর্তৃক অবমাননাকারীকে কারণ দর্শানোর সুযোগ প্রদান করতে হবে এবং তার বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতে হবে। তৎপর আদালত কারণ লপিবদ্ধ করে দন্ডাদেশ ঘোষণা করবেন। এ ধরণের সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে অনধিক ২০০ (দুইশত) টাকা জরিমানা দন্ডে বা জরিমানা অনাদায়ে ১ (এক) মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা যাবে।
আদালত অবমাননার ক্ষেত্রে গৃহীত কার্যক্রমের একটি কল্পিত নমুনাঃ
অদ্য ২৬/৬/৯৫ ইং বেলা ১২-০০ ঘটিকার সময় আমি ম্যাজিষ্ট্রেট ‘গ’ এর আদালত চলাকালীন সময়ে সিআর মামলা নং ৪১/৯৫ এর অভিযোগ গঠন সম্পর্কিত ব্যাপারে ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪১ (ক) ধারা মোতাবেক উভয় পক্ষকে শুনানীকালে বাদী ও বিবাদী পক্ষের যথাক্রমে ‘ক’ এবং ‘খ’ প্রথমে তাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া এবং পরে হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। আদালত দায়িত্ব পালনরত পুলিশ এবং উপস্থিত বিজ্ঞ কৌশুলীগণ মারামারিরত ব্যক্তিদেরকে থামান। উল্লিখিত ব্যক্তিদের এ ধরণের কর্য ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮০ ধারামতে আদালত অবমাননার শামিল।
উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে আদালত অবমাননার দায়ে কেনো তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮০ ধারা অনুসারে কার্যক্রম গ্রহণ করে দন্ডবিধির ২২৮ ধারায় শাস্তি প্রদান করা হবে না এ মর্মে এখনি কারণ দর্শাতে বলা গেল।
উক্ত ব্যক্তিদের দর্শানো কারণ শুনা গেলো। আদালত তাদের দর্শিত কারণে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো কোনো যুক্তি খুঁজে পায়নি। তারা তাদের কৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত হননি বা ক্ষমা প্রার্থনা করেননি।
এমতাবস্থায় আমি ‘গ’ প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট লালমনিরহাট, ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮০ ধারা অনুসারে বিবাদীদেরকে দন্ডবিধির ২২৮ ধারার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের প্রত্যেককে ৫০ (পঞ্চাশ) টাকা করে জরিমানা দন্ডে দন্ডিত করা হলো, জরিমানা অনাদায়ে ৩ (তিন) দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ড ভোগ করবে।
স্বাক্ষর
‘গ’
ম্যাজিষ্ট্রেট প্রথম শ্রেণী
লালমনিরহাট।
(খ) দন্ডবিধির ২২৮ ধারার কার্যক্রমঃ
আদালত যদি কোনো ক্ষেত্রে মনে করেন যে, আদালতের দৃষ্টি গোচরে বা উপস্থিতিতে কৃত আদালত অবমাননার জন্য কোনো ব্যক্তির কারাদন্ড বা ২০০ (দুইশত) টাকার অধিক জরিমানা দন্ড হওয়া উচিৎ অথবা আদালত যদি মনে করেন যে, ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮০ ধারা অনুসারে বিষয়টি নিস্পত্তি হওয়া উচিৎ নয় তাহলে আদালত অপরাধের বিবরণ ও আসামীর বিবৃতি লিপিবদ্ধ করে উহা বিচারের জন্য এখতিয়ার সম্পন্ন কোনো ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করতে পারবেন এবং উক্ত ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হাজির হওয়ার জন্য আসামীকে জামানত দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন এবং জামানত যদি না দেয়া হয় তাহলে আসামীকে গ্রেফতার করে উক্ত ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করবেন এবং তিনি নির্ধারিত পদ্ধতিতে মামলাটি নিস্পত্তি করবেন (ফোজদারী কার্যবিধির ৪৮২ ধারা)।
উপরোক্ত উল্লিখিত পদ্ধতিতে অপরাধী ৬ (ছয়) মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ডে অথবা ১০০০ (এক হাজার) টাকা পর্যন্ত জরিমানা দন্ডে দন্ডিত হবে, কারণ দন্ডবিধির ২২৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো সরকারী কর্মচারী কোনো বিচার বিভাগীয় মামলার কার্যক্রমের যে কোনো পর্যায়ে কার্যরত থাকলে যদি কোনো ব্যক্তি তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করে বা তার কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে তাহলে সে ব্যক্তি ৬ (ছয়) মাস পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদন্ড কিংবা ১০০০ (এক হাজার) টাকাপর্যন্ত যে কোনো অংকের জরিমানা দন্ডে অথবা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডিত হবে।
ক্ষমা প্রার্থনা করলে অপরাধীর অব্যাহতিঃ
আইন অনুসারে করতে বাধ্য হওয়া সত্বেও কোনো কাজ করতে অস্বীকার করার বা না করার অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে অবমাননা করার বা বাধা প্রদান করার জন্য কোনো আদালত ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮০ বা ৪৮২ ধারা অনুসারে কোনো অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান করলে অথবা বিচারের জন্য তাকে কোনো ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করা হলে উক্ত অপরাধী যদি আদালতের আদেশ বা শর্ত মেনে নেয় বা আদালতের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে আদালত সন্তুষ্টক্রমে তাকে অব্যাহতি দান করতে পারবেন বা তার দন্ড মওকুফ করতে পারবেন (ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮৪ ধারা)।
(গ) আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬ অনুযায়ী কার্যক্রমঃ
লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোষ্টার, সংবাদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে বিবৃতি প্রদান করার, কোনো কিছু লেখার বা প্রকাশ করার কারণে আদালত অবমাননা হতে পারে। এক্ষেত্রে আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬ অনুসারে অপরাধীর বিচার হবে এবং হাইকোর্ট বিচার নিস্পত্তি করবেন।
আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬ এর ৩ ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট আদালত অবমাননাকারীকে অনধিক ৬ (ছয়) মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ডে বা অনধিক ২০০০ (দুই হাজার) টাকা জরিমানা দন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করতে পারেন। তবে অপরাধী ক্ষমা প্রার্থনা করলে আদালত সন্তুষ্ট হয়ে অপরাধীকে অব্যাহতি দিতে পারবেন বা প্রদত্ত দন্ড মওকুফ করতে পারবেন।