⚖️ সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ কি?

  • Author: MD Sirajul Islam, Inspector of Police
  • Published: 5 days ago
  • Category: অপরাধ বিজ্ঞান

মানুষ সামাজিক জীব। সৃষ্টির উষালগ্ন পার হইয়া মানুষ যখন দলবদ্ধ হইয়া চলাফিরা বা বসবাস করিতে শিখে তখন হইতে তাহারা নিজেদের মতো করিয়া কিছু কিছু নিয়ম কানুন বা রীতি-নীতি তৈরী করিয়া মানিয়া চলিতে থাকে। ঐ সকল নিয়ম-কানুন বা বাধা-নিষেধ  পরবর্তীতে সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে আধুনিক হইতে আধুনিকতর হইতে থাকে। বর্তমান সভ্য সমাজ, সমাজের অনুশাসন মানিয়া চলিতে অভ্যস্ত। কিন্তু মানুষ সভ্য হইলেও সমাজের নানা স্তরের মানুষ নানা কারণে এই সভ্যতাকে নানাভাবে কলুষিত করিয়া থাকে। যে সকল কারণে মানুষ জীবনকে বিষময় করিয়া তুলে, সেইগুলিই বর্তমান সমাজ জীবনে সামাজিক সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত। সামাজিক সমস্যাগুলি প্রত্যেকটিই সমাজের মধ্যে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করিয়া সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করিয়া থাকে। এই সামাজিক সমস্যাগুলিই সামাজিক অবক্ষয় হিসাবে চিহ্নিত। সামাজিক অবক্ষয়ের জন্য বেশ কিছু কারণ বিদ্যমান রহিয়াছে, যেগুলি সমাজকে প্রতিনিয়ত নষ্ট করিয়া থাকে। যেমন-


(১) দারিদ্রতাঃ দারিদ্রতার কারণে অনেক সময় মানুষ সমাজ ও সমাজের মানুষগুলিকে ভূলিয়া যায় এবং চুরি, ডাকাতি, সম্পত্তি বিনষ্ট ইত্যাদি দ্বারা অপরাধীরা প্রত্যক্ষভাবে সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করিয়া থাকে। 


(২) পুষ্টিহীনতাঃ পুষ্টিহীনতার কারণে একটি কর্মক্ষম মানবগোষ্টী গড়িয়া উঠিতে পারে না। ফলে সমাজে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। 


(৩) জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ জনসংখ্যা বৃদ্ধি বর্তমান সমাজে একটি ভয়ানক সমস্যা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ১নং সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত। উহার কারণে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অসংখ্য সমস্যা সৃষ্টি হইতেছে এবং সামাজিক অবক্ষয়ের চাপে মানুষ দিন দিন ভাড়াক্রান্ত হইয়া পড়িতেছে। সমাজে অপরাধ বৃদ্ধি পাইতেছে। 


(৪) অশিক্ষাঃ অশিক্ষা সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। উহার প্রভাবে বা শিক্ষার অভাবে মানুষ সামাজিক অবক্ষয়ের বেড়াজাল হইতে বাহির হইয়া আসিতে পারে না। অশিক্ষিত জনগোষ্টী সমাজের বোঝা হইয়া পড়ে। তাহারা সমাজকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করিয়া থাকে। বাংলাদেশে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্টী এই অশিক্ষার কবলে পড়িয়া আছে এবং সমাজের বাকি অর্ধেক অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করিয়া সামাজিক অস্থিরতাকে দিন দিন বাড়াইয়া তুলিতেছে। মানুষ নৈতিকতা ভূলিতেছে। 


(৫) সন্ত্রাসঃ বর্তমান সভ্য সমাজে সন্ত্রাস একটি বিষফোঁড়া হিসাবে আবির্ভুত হইয়সাছে। অনেক অনেক ক্ষেত্রে মানুষ সন্ত্রাসের নিকট পরিবার পরিজনসহ জিম্মি হইয়া পড়িয়াছে। সমাজের কোনো ভালো বা উন্নয়নমূলক কাজে ব্যক্তি সন্ত্রাস বা গোষ্টী সন্ত্রাস সমাজের মূল কাঠামো ধরিয়া টান দিতেছে। যাহার ফলে সমাজ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। সন্ত্রাসীরা প্রতিনিয়ত সমাজবিরোধী কার্যকলাপ দ্বারা সমাজের উপর নানাভাবে আঘাত করিয়া সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করিতেছে। 


(৬) অতিরিক্ত চাহিদাঃ মানুষের চাহিদা সীমাহীন এবং সমাজে উহা যোগানোর সীমাবদ্ধতা রহিয়াছে। এই অতিরিক্ত চাহিদা হইতে লোভের উদ্ভব হয়। যাহার ফলে চাহিদা পূরণ করার জন্য সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, প্রথা, মূল্যবোধ এবং সামাজিক ধ্যান-ধারণা ভূলিয়া সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করিয়া থাকে। 


(৭) পরিবারঃ মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হইলেও সে কোনো-না-কোনো একটি পরিবারের সদস্য। সেই পরিবারই কোনো ব্যক্তির বাড়িয়া উঠার সূতিকাগার। সেখানেই সব ধরণের শিক্ষার ভিত্তি রচিত হয়। পরিবার প্রধানকে তাই তাহার প্রত্যেক সদস্যকে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে এবং নৈতিক শিক্ষা দিতে হইবে। দারিদ্রতার কারণে পরিবারের কোনো সদস্য যেন সামাজিক মূল্যবোধগুলি ভূলিয়া না যায় সেই দিকে খেয়াল রাখিতে হইবে। জনসসংখ্যা বৃদ্ধির বিষটিও পরিবার হইতেই নিয়ন্ত্রণে রাখিতে হইবে। পরিবারের সদস্যদের শিক্ষিত করিয়া সমাজে প্রতিষ্টিত করার উদ্দ্যোগ নিতে হইবে। পরিবারের কোনো সদস্য যাহাতে কোনো ধরণের সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ডে জড়িত না হয় সেইদিকে খেয়াল রাখিতে হইবে। পরিবারের সদস্যগণ যাহাতে পরিবারের আর্থিক সামর্থ অনুযায়ী জীবনধারণে সন্তুষ্ট থাকে সেইদিকে খেয়াল রাখিতে হইবে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সদস্যদের সম্পৃক্ত রাখিতে হইবে। 


(৮) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হইল মানুষ গড়ার কারখানা। যেই কারখানায় উৎপাদন যত বেশি মানসম্পন্ন, সেই কারখানার সুনামত্ত বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। তেমনি যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা,  শিক্ষা এবং আনুষাঙ্গিগ কর্মক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করিতে পারে, সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজে সগৌরবে প্রতিষ্ঠা পাইয়া থাকে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হইতে প্রকৃত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করিতে হইবে, যাহাতে শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, সাংস্কৃতিক শিক্ষা, মানবিক শিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা, আচার-আচরণ শিক্ষা ইত্যাদি লাভ করিয়া সমাজে মানুষের মতো মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে। 


(৯) সামাজিক প্রতিষ্ঠানঃ সমাজে মানুষের কল্যাণার্থে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক প্রতিষ্ঠান রহিয়াছে। সেখানে সমাজের প্রত্যেক সদস্যের সমান অধিকার নিশ্চিত করিতে হইবে। সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টিকারী বিষয়গুলি যাহাতে সদস্যদেরকে কলুষিত করিতে না পারে, সেইদিকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীকে দৃষ্টি রাখিতে হয়। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে সকলের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, মমত্ববোধ, বিবেকবোধ তথা মানুষ্যবোধ জাগ্রত করিতে হইবে। ভালোকে ভালো বলার এবং মন্দকে ভালোর দ্বারা শোধরাইয়া নেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। প্রত্যেককে সমাজের সাথে খাপ খাওয়াইয়া নেওয়ার তথা সহনশীল হওয়ার পথ দেখাইতে হইবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সকলে সমেবেত হইয়া প্রতিরোধ গড়িয়া তোলার জন্য ভূমিকা নিতে হইবে। 


সর্বপরি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্নীতিমুক্ত থাকিয়া স্বজনপ্রীতি পরিত্যাগ করিয়া স্বদেশ প্রেমে উদবুদ্ধ হইয়া সামাজিক কর্মকান্ডগুলি পরিচালনা করিলে সামাজিক অবক্ষয়গুলি দূরিভূত হইবে।